কক্সবাজার, মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪

পরিচয় দেয় প্রশাসনের সোর্স

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মনিয়া সিন্ডিকেটের ত্রাসের রাজত্ব

এম ফেরদৌস ওয়াহিদ, উখিয়া::

উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের সাথে আঁতাত করে মাদক কারবার, অপহরণ বাণিজ্য, দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ড, অস্ত্র ঠেকিয়ে সন্ত্রাসী কায়দায় ডাকাতি ,পাহাড় কেটে মাটি বিক্রিসহ অসংখ্য অপরাধ কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িয়ে থ্যাংখালী ক্যাম্পকেন্দ্রিক এলাকায় গড়ে তুলেছে ত্রাসের রাজত্ব। প্রশাসনের সোর্স পরিচয় দিয়ে এসব অপকর্ম চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

জানা গেছে, উখিয়ার থ্যাংখালী ঘোনারপাড়া এলাকার মৃত আব্দু শরীফের ছেলে নুরুল হাকিম প্রকাশ মনিয়া ডাকাত, নুরুল আকতার, নুরুল আমিন, নুরুল বশর, খাইরুল বশর নামে ৫ ভাই এসব অপকর্মে কোনো না কোনোভাবে জড়িত হয়ে ক্যাম্পভিত্তিক এলাকায় নিয়মিত নৈরাজ্য সৃষ্টি করে আসছে ৪-৫ বছর ধরে। তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে একই এলাকার জাফর মিয়ার ছেলে নুরুল কবির ওরফে আববুইয়া ও মিতুর ছেলে ইব্রাহিম। তাদের রয়েছে মার্ডার, মাদক, দেশদ্রোহী, ডাকাতি, বনসহ ডজনখানেক মামলা। দেশের প্রচলিত আইনের প্রতিটি ধারায় তাদের বিরুদ্ধে অপরাধীর দাগ রয়েছে। আইনের শাসন ও দায়িত্বরত প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা বহালতবিয়াতে নৈরাজ্যের রাজত্ব কায়েম করেছে এই এলাকায়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এখানে অনেকের পূর্বপুরুষ ছিল রোহিঙ্গা। কৌশলে তারা বাংলাদেশি নাগরিক হয়ে মিয়ানমারকেন্দ্রিক বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কায়দায় বিভিন্ন কিলিং মিশনের কন্ট্রাক্ট নিয়ে অবৈধ উপায়ে আয় করেছে কোটি কোটি টাকা। রোহিঙ্গা জনগৌষ্ঠীর মধ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গ্রুপে গ্রুপে বিভিন্ন সংঘর্ষের ঘটনায়ও তারা কোনো পক্ষপাত হয়ে অপর পক্ষকে অপহরণ ও হত্যা করার কন্ট্রাক্ট নিত। এমন এক ঘটনার তথ্যানুসন্ধানে উঠে এসেছে, ২০২১ সালে ১৯নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-৩ ব্লকের মো. জাবের নামে এক রোহিঙ্গাকে মোটা অংকের টাকায় কন্ট্রাক্ট নিয়ে নৃশংশভাবে হত্যা করেছিল তারা। এসব হত্যাকাণ্ডের পর থেকে তারা আরো বেপরোয়াভাবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ১৯নং ক্যাম্পে ভয়ংকর রূপে চলাফেরা করত বলে জানিয়েছেন সেখানকার রোহিঙ্গারা।

স্থানীয়রা বলছেন, মনিয়া ডাকাতের গ্রুপটি খুন-খারাবি, মাদক কারবার ছাড়াও নতুন করে শুরু করেছে অস্ত্র ঠেকিয়ে মানুষের জমি জবরদখল। এলাকায় অনেক স্থানীয় মানুষের জমি জবরদখল করেছে সন্ত্রাসী কায়দায়। কেউ মুখ খুললে তাকে হত্যার হুমকি ও অপহরণ করে নেয়ার শর্ত জুড়ে দেয়। জীবন চাইলে জায়গা ছাড়তে হচ্ছে আর জায়গা চাইলে জীবন দিতে হচ্ছে।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, তাদের হাতে রয়েছে দেশি বিদেশি অস্ত্র। তাছাড়া এই গ্রুপের সদস্যরা অনেক মার্ডার করেছে এমন খবরও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এলাকায়। তাই ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলে না। তাদের এসব অপকর্ম নিয়ে ১৯নং পুলিশ ক্যাম্পে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেছেন অনেকে।

স্থানীয় হোস্ট কমিনিউটির সভাপতি বলছেন, ১৩ এবং ১৯নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাটাতাঁরের ঘেরাওর ভেতরে ৪০০+ পরিবার রয়েছে। তারা এমনিতেই রোহিঙ্গাদের বর্বরতা ও গ্রুপে গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনায় আতংকে দিনযাপন করে। তারমধ্যে ঘোনাপাড়ার নুরুল হাকিম প্রকাশ মনিয়া ডাকাতের গ্রুপে কাটাঁতারের ঘেরাওর ভেতরে এসে বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাচ্ছে। তাদের মূল পেশা মাদক কারবার ও ডাকাতি। এরমধ্যে এখন শুরু করেছে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বসতির পার্শ্ববর্তী লাগোয়া বনাঞ্চলের পাহাড়গুলো কেটে মাটি পাচারের কাজ। এসব ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানার পরও কোনো কর্ণপাত করছে না কেউ। অথচ মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার সময় এপিবিএনের চেকপোস্টও আছে। ক্যাম্পের ভেতর থেকে এমেই অন্যন্য গাড়ি বা মানুষ বের হলে তাদের তল্লাশি করা হয় অথচ মাটি নিয়ে যাওয়া গাড়ি তল্লাশিও হয় না, তাদের কেউ বাধাও দেয় না। এসব কি টাকার জোরে নাকি মনিয়া ডাকাতের ভয়ে, সেটা এখনো স্থানীয়দের অজানা।

মনিয়া ডাকাত সিন্ডিকেট নির্বিচারে বনাঞ্চলের পাহাড় কেটে কী মূলে মাটি পাচার করছে- এমন প্রশ্নে উখিয়া রেঞ্জের থ্যাংখালী বিট কর্মকর্তা বিকাশ দাস বলেন, ক্যাম্পের ভেতর বনাঞ্চলের সব জায়গাগুলো সিআইসিরা (ক্যাম্প ইনচার্জ) দেখাশোনা করেন। তারপরও আমরা চেষ্টা করি যাতে কেউ পাহাড় না কাটে। ক্যাম্পের ভেতরে যারা পাহাড় কাটছে, তাদের বিরুদ্ধে অলরেডি মামলা রয়েছে। এদের মধ্যে নুরুল হাকিম, নুরুল আকতার, নুরুল বশরকে আসামি করা হয়েছে। তাছাড়া নুর হাকিম প্রকাশ মনিয়ার একটা ড্রাম্পগাড়ি এখনো রেঞ্জ অফিসে আটক আছে। তারা পাহাড় কাটছে, এটা আমরা অবগত হয়েছি। এ বিষয়ে সিআইসির সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

এসব বিষয়ে ১৯নং ক্যাম্পের সিআইসি (সহকারী সচিব) আল ইমরানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পাহাড় কাটছে রাত ১২টার পর থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত। এখন ওই সময় তো আমি একা মোবাইল কোর্ট  পরিচালনা করতে পারছি না। তারপরেও আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এসব জানিয়েছি এবং ব্যবস্থা নিতে দাপ্তরিক নোটিসও ইস্যু করেছি।

ক্যাম্পের ভেতরে ডুকতে ও বের হতে এপিবিএনের চেকপোস্ট রয়েছে, পাহাড় কাটতে আসার সময় এবং মাটি নিয়ে যাওয়ার সময় তো এপিবিএনের দেখার কথা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই তারা চাইলে মাটি নিয়ে যাওয়ার সময় মাটিসহ গাড়ি আটক করতে পারে। আমি এপিবিএনকেও বেশ কয়েকবার অবগত করেছিলাম কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া মিলেনি।

ক্যাম্পে মনিয়া গ্রুপটা কি অনেক বড় শক্তিশালী গ্রুপ- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা এই গ্রুপের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি। যতবড় শক্তিশালী হোক না কেন, সকল অপরাধীকে আইনের আওতায় আসতেই হবে।

এসব ঘটনা ও অপরাধীদের বিষয়ে কথা বলতে ১৯নং ক্যাম্পের দায়িত্বরত ৮ম এপিবিএনের দায়িত্বরতদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

তাদের রোহিঙ্গাদের বংশধর ও ডাকাত গৌষ্ঠী তকমা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সেলিম উদ্দিন বলেন, নুরুল হাকিম প্রকাশ মনিয়া, নুরুল বশর এদের ভাই গ্রুপ্টা ক্যাম্পের ভেতরে এবং বাইরে প্রকাশ্যে বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এখানে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি হিসেবে পরিচিত। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে দেশের প্রত্যেক অপরাধের ধারায় মামলা রয়েছে। তারপরও তারা বহালতবিয়াতে এসব কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। এসবের পেছনে কিছু স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিও জড়িত। ২০২২ সালে তাদের আস্তানায় প্রশাসন যৌথ অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করছিল। এখনো তাদের গ্রেফতারপূর্বক অভিযান পরিচালনা করলে বিপুল পরিমাণ দেশি বিদেশি অস্ত্র মিলতে পারে।

পাঠকের মতামত: